সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

বরগুনা জেলা

 



বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী জেলা বরগুনা। এই জেলার অভ্যন্তরে ছড়িয়ে - ছিটিয়ে রয়েছে নদীর পর নদী। নদীতে নৌকা নিয়ে মাঝি চলে যায় দূরদেশে। নীল বাদাম ওড়ায় নৌকাতে। ঢেউয়ের তালে নৌকা হেলেদুলে চলে যায়। এ দৃশ্য দেখে অভিভূত হতে হয়। মাঝির কন্ঠে গান শোনা যায়..... মাঝি বাইয়া যাওরে অকূল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাওরে... আরে কত কী গান।
বরগুনা দক্ষিণাঞ্চলের জেলা। এর উত্তরে ঝালকাঠি জেলা, বরিশাল জেলা, পিরোজপুর জেলা ও পটুয়াখালী জেলা, দক্ষিণে পটুয়াখালী জেলা ও বঙ্গোপসাগর, পূর্বে পটুয়াখালী জেলা, পশ্চিমে পিরোজপুর জেলা ও বাগেরহাট জেলা। জেলা সদরে বরগুনা শহর। একটি পৌরসভা। ৯ ওয়ার্ড ও ১৮ মহল্লা ও বেতাগী উপজেলা।
⚫
বরগুনা জেলার ইতিহাস
১৯৬৯ সালে বরগুনা পটুয়াখালী জেলার অধীনে একটি মহকুমা হয় ।১৫ ফাল্গুন ১৩৮৯ বঙ্গাব্দে (১৯৮৪ সাল) দেশের প্রায় সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হলে বরগুনা জেলায় পরিণত হয়।
বরগুনা নামের ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও জানা যায় যে, উত্তরাঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ীরা এতদ্ঞ্চলে কাঠ নিতে এসে খরস্রোতা খাকদোন নদী অতিক্রম করতে গিয়ে অনুকূল প্রবাহ বা বড় গোনের জন্য এখানে অপেক্ষা করত বলে এ স্থানের নাম বড় গোনা। কারো মতে আবার স্রোতের বিপরীতে গুন(দড়ি) টেনে নৌকা অতিক্রম করতে হতো বলে এ স্থানের নাম বরগুনা । কেউ কেউ বলেন , বরগুনা নামক কোন প্রতাপশালী রাখাইন অধিবাসীর নামানুসারে বরগুনা । আবার কারো মতে বরগুনা নামক কোন এক বাওয়ালীর নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ করা হয় বরগুনা ।
⚫
বরগুনার দর্শনীয় স্থান।
বরগুনা একটি ঐতিহাসিক প্রাচীন জেলা। বরগুনা জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ..... সোনা কাটা সমুদ্র সৈকত, টেংরা গিরি ইকোপার্ক, লাল দিয়া বন, ফাতরার বন, বিবি চিনি মসজিদ, হরিণ ঘাটা, নিদ্রা, বেতাগী, মোকামিয়া, হোসনাবাদ, বামনা, বুকাবুনিয়া, বড় মজুমদার, কাজীরবাদ, দাওয়াতলা,সরিষামড়ি, বরবগী, গুলশাখালী, কুকুয়া, কুঁড়ির চর, রায়হান পুর, কাকচিড়া, নাচনাপাড়া, কালমেঘা, কাঁঠাল তলী, বড়বিঘাই, বড় পাঙ্গাশিয়া, ধানখালী, হলদিয়া, লালদিয়া ইত্যাদি।
আসুন জেনে নেই বরগুনা জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে.....
⚫
টেংরাগিরি ইকোপার্ক..
বরগুনা জেলার তালতলি উপজেলা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে সোনা কাটা ইউনিয়নে সুন্দর বনের একাংশে টেংরাগিরি অভায়রন্য গড়ে তোলা হয়েছে। টেংরাগিরি অভয়ারণ্যের পাশেই রয়েছে আর একটি আকর্ষনিয় পর্যটন কেন্দ্র সোনা কাটা সমুদ্র সৈকত। সুন্দর বনের পরেই এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় শ্বাসমূলীয় বন যা দিনে দুইবার জোয়ার ভাটায় প্লাবিত হয়। লবনাক্ত ও মিষ্টি মাটির অপূর্ব মিশ্রণে এখানে এখনো টিকে রয়েছে হাজার প্রজাতির বিলুপ্ত গাছ, পশুপাখি ও সরীসৃপ। প্রায় ৪০৪৮ হেক্টর জায়গা জুরে পূর্ব পশ্চিমে ৯ কিলোমিটার ও উত্তর দক্ষিণে ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত এই বনের বিস্তৃতি।
⚫
শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত...
অথৈ সাগরে ঢেউ আর সবুজ ঝাউ বনে ঘেরা বরগুনা জেলার তালতলি উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের নলবুনিয়ায় অবস্থিত এক দৃষ্টিনন্দন সৈকতের নাম শুভ সন্ধ্যা। পায়রা, বিশ খালি ও বলেশ্বর নদীর মিলনস্থলের বৈচিত্র্য বাড়িয়ে তুলেছে প্রায় ৪ কিলোমিটার লম্বা বেলাভূমি শুভ সন্ধ্যা। তালতলি উপজেলা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এটির অবস্থান। শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতের বিশুদ্ধ বাতাস, সমুদ্রের কল - কল আওয়াজ, নির্জন প্রকৃতি ভ্রমণ পিপাসুদের সহজেই আকর্ষণ করে।
⚫
লাল দিয়া বন বা সমুদ্র সৈকত...
লাল দিয়া সমুদ্র সৈকত বরগুনা জেলার পাথর ঘাটা উপজেলার দক্ষিণে অবস্থিত। লাল দিয়ার বনের পূর্ব দিকে বিশ খালি পশ্চিম দিকে বলেশ্বর নদী বয়ে গেছে। দুই নদী এবং সাগরের মোহনায় ঘেরা এ বনের পূর্ব প্রান্তে সমুদ্র সৈকতের অবস্থান। লালদিয়া বনের পাখির কিচির মিচির, সমুদ্রের বুনো সৌন্দর্য, লাল কাকরার হেটে চলা আর গাঙচিল ভ্রমণ পিপাসুদের মনকে প্রকৃতির সাথে একাত্ম করে দেয়।
⚫
হরিণ ঘাটা পর্যটন কেন্দ্র...
প্রাকৃতিক বন আর সাগরের হাতছানিতে মুগ্ধ ঘুরে আসতে পারেন দক্ষিণ বরগুনা জেলায় অবস্থিত হরিণ ঘাটা পর্যটন কেন্দ্র থেকে। জানা অজানা গাছ আর বন্য প্রাণীর বিচরণ স্থান এ বন সুন্দর বনেরই একটা অংশ। যান্ত্রিক কোলাহলের বাহিরে পাখির কলকাকলীতে ও প্রকৃতির নৈসর্গিকতায় দেখা হয়ে যেতে পারে হরিণ, বানর, শূকর সহ আরও অনেক বন্য প্রাণী। অপূর্ব এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্য রয়েছে ওয়াচ-টাওয়ার। বনের মধ্যে তৈরি রাস্তা দিয়ে পর্যটকরা বনের ভিতরে ঘুরে দেখতে পারে।
⚫
বিবি চিনি মসজিদ....
বাংলাদেশ মোঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন বিবি চিনি মসজিদ। বরগুনা জেলার বেতাগি উপজেলার বিবি চিনি ইউনিয়নে ছোট টিলার উপর নির্মাণ করা হয়েছে এই মসজিদ। এই মসজিদটি বেতাগি শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জানা যায় হযরত শাহ নেয়ামত উল্লাহর কন্যা চিনি বিবি ও ইছা বিবির নাম অনুসারে বিবি চিনি গ্রাম ও মসজিদের নামকরণ করা হয়। মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৩৩ ফুট এবং দেয়াল ৬ ফুট চওড়া, উচ্চতায় এটি প্রায় ২৫ ফুট।
এরপর আসি সবথেকে আকর্ষণের যায়গায়....
⚫
রাখাইন পল্লী...
বরগুনা জেলার তালতলি উপজেলায় রয়েছে একাধিক রাখাইন পল্লী। আরাকান থেকে বামার বা বারমিজদের দ্বারা বিতারিত হয়ে রাখাইনরা এ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। বন জঙ্গল কেটে তারাই প্রথম এ অঞ্চলকে বসবাস এবং ফসল আবাদের উপযোগী করে গড়ে তোলে। লবনাক্ত পানি পানের উপযোগী না হওয়ায় তারা বাড়ির পাশে কুয়া খনন করে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করে রাখতো এবং বন্য পশুর হাত থেকে বাচতে টোং বা মাচায় ঘর তৈরি করতো।
তাদের আত্মারক্ষার এ পদ্ধতি এখন রীতিতে পরিনত হয়ছে। তারা তাদের শত বছরের সংস্কৃতি ধরে রেখেছে।
শত বছরের পুরনো বৌদ্ধ মঠ, বিক্ষু মুর্তি এ অঞ্চলে এখনো বিদ্যমান।
⚫
উল্লেখযোগ্য খাবার।
বরগুনা জেলা নারিকেল ও সুপারির জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও বরগুনার বিখ্যাত খাবার -চুইয়া পিঠা, চ্যাবা পিঠা, মুইট্টা পিঠা, আল্লান, বিসকি, তালের মোরব্বা, ইত্যাদি ।
⚫
চুই পিঠা বানানোর পদ্ধতি...
পানি ফুটিয়ে চালের গুঁড়া দিয়ে ডো করে নিন। চুলা থেকে হাঁড়ি নামিয়ে কিছুটা ঠান্ডা করে বেশ ভালোভাবে ডো/কাই ময়ান দিয়ে নিন। ময়ান দেয়া হলে অল্প করে ডো নিয়ে লেচি কেটে সেমাই বানিয়ে নিন।
সব বানানো হলে চুলায় দুধের হাঁড়ি বসান। দুধ ফুটে উঠলে এক কাপ দুধ উঠিয়ে রাখুন। এই এক কাপ দুধ ঠান্ডা করে তাতে গুঁড় গলিয়ে ছেঁকে রাখুন।
এইবার দুধের সাথে কনডেন্সড মিল্ক, এলাচ গুঁড়া ও স্বাদমতো চিনি দিয়ে জ্বাল করুন। চিনির পানি শুকিয়ে গেলে অল্প অল্প করে তৈরি করে রাখা সেমাই মিশিয়ে নিন। পছন্দমতো ঘন হলে নামিয়ে নিন। সেমাই কুসুম গরম হলে গুঁড়-দুধের মিশ্রণ মিশিয়ে নিন।
** ঠান্ডা হলে কিসমস ও পেস্তা কুচি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।
⚫
বিসকি রান্নার পদ্ধতি...
প্রথমে চাল ভেজে ভিজিয়ে রাখতে হবে ২ ঘন্টা। তারপর চাল ভিজে গেলে ধুয়ে ঝুরিতে তুলে রাখতে হবে। কিছু নারকেল কুরিয়ে নিতে হবে। আবার কিছু নারিকেল কিউব করে কেটে নিতে হবে। এখন একটি পাতিলে পানি, নারিকেল, গুড় ও তেজপাতা দিয়ে ফুটাতে হবে। ফুটে উঠলে ভাজা চাল দিতে হবে। ঢেকে রান্না করতে হবে। এটা পোলাউর মত রান্না করতে হয়। যদি পানি শুকিয়ে যায় আর চাল সিদ্ধ না হয় তাহলে আবার পানি দেয়া যাবে। জর্দ্দার মত ঝর ঝরে হলে নামাতে হবে। ঠান্ডা হলে পরিবেশন করতে হবে মজাদার বিসকি।
⚫
শিরনি রান্নার পদ্ধতি....
প্রথমে ময়দা তে ঘি মাখিয়ে নিতে হবে। এবার অল্প অল্প করে দুধ মিশিয়ে ময়দাটা স্টিকি করে মাখতে হবে মাখা হয়ে গেলে এর মধ্যে চিনি মেশাতে হবে এবং কাঁঠালি কলা চটকে এর সাথে মাখিয়ে নিতে হবে।
পুরো মিশ্রণটি খুব মোলায়েম করে মাখতে হবে। এরপর এর মধ্যে শসা কুচি আপেল কুচি খেজুর বেদানা আঙ্গুর গুড়ের বাতাসা এবং মুরকি দিয়ে মাখতে হবে।
খুব ভালো মত স্মুথ ভাবে মাখা হয়ে গেলে উপর থেকে নারকেলকোরা ছড়িয়ে দিলেই রেডি হয়ে যাবে একদম প্রসাদের মত শিন্নি।
⚫
বরগুনা জেলায় যাওয়ার উপায়।
রাজধানী ঢাকা থেকে বরগুনা সদরের দূরত্ব ২৪৭ কিলোমিটার আর বিভাগীয় শহর বরিশাল থেকে ৯০ কিলোমিটার। এই জেলাটি একটি উপকূলীয় ও নদীবহুল অঞ্চল হওয়ায় এখানকার যেকোনো স্থানে আসার জন্য নৌপথ সবচেয়ে সুবিধাজনক পরিবহন ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে লঞ্চ হলো সব থেকে আরাম দায়ক নৌযান। নদীর মাতাল হাওয়া, খোলা আকাশের জোস্না, পানির কল - কল শব্দ উপভোগ করতে করতে সহজেই যাওয়া যায় বরগুনা। তবে, সড়ক পথেও এখানে আসা সম্ভব; সেক্ষেত্রে কিছু বছর আগেও ফেরী পারাপার হতে হতো। কিন্তু এখন পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ায় ঢাকা থেকে সরাসরি বাস যোগে বরগুনা যাওয়া যায়। বরগুনায় রেল যোগাযোগ বা বিমান বন্দর নেই বলে এই দুটি মাধ্যমে এখানকার কোনো স্থানে আসা যায় না।
⚫
বরগুনা এসে কোথায় থাকবেন।
বরগুনায় থাকার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের কিছু সাধারণ মানের হোটেল রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় থাকার জন্যে উন্নতমানের -
জেলা পরিষদ ডাকবাংলো - বরগুনা।
হোটেল তাজবিন - সদর।
হোটেল বে অব বেঙ্গল - সদর রোড, বরগুনা।
এই হলো আমাদের উপকূলবর্তী শহর বরগুনা। সবাইকে ঘুরে যাওয়ার অনুরোধ রইলো।
---সংগৃহীত---

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন