সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ‘ছাড়’ দেবে সরকার

 

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু

টানাপোড়েন দূর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে মনোযোগী হচ্ছে সরকার। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যেসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করে দেশটির কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতাসীন দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার তাদের সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু মঙ্গলবার (১৪ মে) ঢাকা আসছেন। তার সফরকে কেন্দ্র করে সরকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এই প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এখনই উপযুক্ত সময়। কারণ একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ এখন অনেক বেশি স্থিতিশীল। এই সময় সরকার আর কোনো বিরোধে জড়াতে চায় না। চীন ও ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। 

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবার (১২ মে) ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আসবেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী আবদুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক দিন দিন শক্তিশালী হতেই পারে। শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলে এই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। 

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম খবরের কাগজকে বলেন, মার্কিন প্রশাসন বুঝতে পেরেছে চাপ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে কিছু আদায় করা যাবে না। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমাদের সরকারও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে তাদের সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সব সময় একই আছে। সবার সঙ্গেই আমরা সুসম্পর্ক রাখতে চাই। আর যুক্তরাষ্ট্রের কথা তো আলাদা। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর পরই সরকার এ ব্যাপারে সক্রিয় হয়। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকায় আমি হলফ করে বলতে পারি, এখনো এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। বর্তমানে পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা ও ওয়াশিংটন সম্পর্ক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে।

একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব জেনে বিদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিতে পারে সরকার। এমনকি চীনকে মোকাবিলায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের যে চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত রেখেছে, সে বিষয়েও সহযোগিতার ইঙ্গিত দেওয়া হতে পারে। বিশেষ করে বিদ্রোহকবলিত অস্থির মায়ানমারে আসছে দিনগুলোতে অন্য পরাশক্তির ভূমিকা কী হতে পারে, তাও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে অভিজ্ঞ মহলকে। এর বাইরে রাশিয়া ও চীনের ওপর থেকে সামরিক নির্ভরতা কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির বিষয়েও ইতিবাচক আশ্বাস দিতে পারে সরকার। তবে সব কিছুর আগে আওয়ামী লীগ সরকার চায় র‌্যাবের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করুক। এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আশ্বাস পেলেই তারা ছাড় দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে জানাবে। 

জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। নির্বাচনের পর লুসহ মার্কিন সরকারের উচ্চপর্যায়ের কূটনীতিকদের সঙ্গেও সরকারের প্রতিনিধিরা যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। তিক্ততা ভুলে সম্পর্ক উন্নয়নের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক খবরের কাগজকে জানিয়েছেন। 

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অতিমাত্রায় তৎপর এবং বিরোধী দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলে ক্ষুব্ধ হয় আওয়ামী লীগ সরকার। তারপর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন, যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।

বলা হচ্ছে, ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক জোরদার ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখা নিয়ে আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এই দফা বাংলাদেশে আসছেন। তবে ঢাকায় সরকারি মহল এই সফরে বিশেষ কিছু দেখছেন। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, সম্পর্ক জোরদারের আগে তা স্বাভাবিক করা এখন দুই পক্ষের কাছেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। 

এই সফরে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলে তারাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। সে ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত ছাড় পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হবে। তবে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকেই আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। 

র‌্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াসহ মানবাধিকার ইস্যুতে যখন তখন বিবৃতি এবং বিরোধী পক্ষ বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা দফারফাও করতে চায় সরকার। তা হলে সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের যে হুমকি বারবার যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছিল, তা দূর হবে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ের অভাবে সরকারের বিরোধী শক্তিরা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।

শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভারত ও শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ এশিয়ায় ছয় দিনের সফরের শেষ সময়টা ডোনাল্ড লু বাংলাদেশে কাটাবেন। সেখানে তিনি জলবায়ুসংকট মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরকরণসহ মার্কিন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন। দুই দিনের সফরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কয়েকটি বৈঠক ও মতবিনিময় সভায় অংশ নেবেন তিনি। ডোনাল্ড লু পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। 

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্যই এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে এবং প্রত্যাশিত ভূমিকার ফলে এ সম্পর্ক আগামীতে সুদৃঢ় হতে পারে।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন